এই সপ্তাহের শেষে জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজায় পুনরায় ‘তীব্র যুদ্ধ’ শুরু করার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল, অন্যদিকে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে জোর দিয়ে বলেছে তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জেরুজালেম থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
গাজায় ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে যুদ্ধ বিরতির শর্তাবলী অনুসারে, ইসরাইলি হেফাজতে থাকা ফিলিস্তিনিদের বিনিময়ে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে পাঁচদফা জিম্মি-বন্দি বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় এই চুক্তি ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে পড়েছে, যার ফলে এটি পুনরুদ্ধারের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে এবং হামাস বলেছে যে তারা ‘যুদ্ধবিরতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
হামাসের অভিযোগ, ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজায় ফিরে যেতে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। পাশাপাশি গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ। তাই আপাতত ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে না বলে জানায় হামাস।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যদি হামাস শনিবার দুপুরের মধ্যে তাদের জিম্মিদের ফেরত না দেয়, তাহলে যুদ্ধবিরতি শেষ হয়ে যাবে এবং আইডিএফ (ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী) হামাসকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত না করা পর্যন্ত তীব্র লড়াই চালিয়ে যাবে।
তার এই হুমকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ট্রাম্প সোমবার বলেন, হামাস যদি শনিবারের মধ্যে ‘সকল’ ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয় তবে ‘নরক’ভেঙে পড়বে। ইতোপূর্বে গাজা দখল এবং এর ২ লক্ষাধিক বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘যদি শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে সমস্ত জিম্মিদের ফেরত না দেওয়া হয়, বলব এটি বাতিল করুন এবং সমস্ত বাজি বন্ধ হয়ে যাক এবং নরক শুরু হোক।’ মঙ্গলবার জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহকে স্বাগত জানানোর সময় তিনি তার সময়সীমা পুনর্ব্যক্ত করেন।
ট্রাম্পের বক্তব্যের এক দিন পর হামাসকে প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি দেন নেতানিয়াহু! সঙ্গে হামাসের যাবতীয় অভিযোগও অস্বীকার করেছেন তিনি। তার দাবি, গাজায় সাহায্য প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগটি অসত্য। যুদ্ধবিরতির কোনও শর্তও ভাঙেনি ইসরায়েল। যারা যারা ইসরায়েলি সেনাছাউনি থেকে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখছেন না, কেবল তাদেরই গুলি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার নেতানিয়াহু বলেন, ‘হামাসের চুক্তি লঙ্ঘন এবং জিম্মি মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর আমরাও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সোমবার রাত থেকেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে গাজা উপত্যকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার সঙ্গে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল।
এদিকে বাদশাহ আবদুল্লাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে জর্ডানের দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, এটি ‘ঐক্যবদ্ধ আরবের অবস্থান।’ হামাসের সিনিয়র নেতা সামি আবু জুহরি বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য ‘বিষয়গুলোকে পুনরায় জটিল করে তুলছে। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘ট্রাম্পের মনে রাখা উচিত, একটি চুক্তি হয়েছে, যেটিকে উভয় পক্ষকেই সম্মান করতে হবে।’
গাজার সীমান্তবর্তী মার্কিন মিত্র মিসর মঙ্গলবার বলেছে, তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ‘পুনর্নির্মাণের জন্য একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন’ করার পরিকল্পনা করছে যা বাসিন্দাদের তাদের নিজস্ব ভূমিতে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ইসরায়েলকে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে এবং তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণের আহ্বান জানিয়ে হামাস বলেছে, তারা শনিবারের জন্য নির্ধারিত পরবর্তী জিম্মি মুক্তি স্থগিত করবে।
জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস হামাসকে পরিকল্পিত মুক্তির বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়ার এবং ‘যে কোনও মূল্যে গাজায় শত্রুতা পুনরায় শুরু করা এড়াতে’ আহ্বান জানিয়েছেন। হামাসের সঙ্গে জোটবদ্ধ ও যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনির সমর্থনে ইসরায়েলে হামলাকারি ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা ‘গাজার বিরুদ্ধে উত্তেজনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেকোনো সময় সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করতে প্রস্তুত।’
নেতানিয়াহু সমস্ত জিম্মিদের কথা বলছেন কিনা তা স্পষ্ট করেননি, তবে তার অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ যদি শনিবারের মধ্যে সমস্ত ইসরাইলি জিম্মিদের ফিরিয়ে না দেয়া হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ‘নরকের দরজা খুলে দেওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। কট্টর-ডানপন্থী এই রাজনীতিবিদ ‘গাজা উপত্যকার পূর্ণ দখল’এবং এর প্রতি সকল মানবিক সাহায্য বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা তাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে, অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির সমর্থনে জিম্মি পরিবার নেতানিয়াহুর অফিসের বাইরে সমাবেশ করেছে। জাহিরো বলেন, ‘একটি চুক্তি হয়েছে। এটি মেনে চলুন!’ গাজায় বন্দী অবস্থায় জাহিরোর চাচা আব্রাহাম মুন্ডার মারা গেছেন।
‘যুদ্ধবিরতি বহাল থাকুক’ এমনি প্রার্থনার কথা জানিয়ে দেইর এল-বালাহের ৬০ বছর বয়সী গাজার বাসিন্দা আদনান কাসেম বলেন,‘ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধ চায়, এবং বিশ্বাস করি হামাসের মধ্যেও এমন একটি দল আছে যারা যুদ্ধ চায়।’ হামাসের সশস্ত্র শাখা, এজ্জেদিন আল-কাসেম ব্রিগেড, শনিবারের জন্য নির্ধারিত জিম্মি মুক্তি স্থগিত করার কয়েক ঘন্টা পরে ট্রাম্পের সর্বশেষ হুমকি এসেছে।
এজ্জেদিন আল-কাসেম ব্রিগেড ইসরাইলকে চুক্তির অধীনে তাদের সাহায্যসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তোলে এবং সপ্তাহের শেষে তিন গাজাবাসীর মৃত্যুর কথা জানায়। তবে দলটি বলেছে, ‘একবার এই দখল অনুসারে’ মুক্তিদান প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ‘দরজা খোলা রয়েছে।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার ফলে গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ওই সময় হামাস ২৫১ জনকে জিম্মি করে, যাদের মধ্যে ৭৩ জন গাজায় রয়ে গেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে জিম্মিদের মধ্যে ৩৫ জন মৃত। কাতারের মধ্যস্থতায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিশরের চেষ্টায় জানুয়ারির শেষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ইসরায়েল এবং হামাস। ২০ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় জানিয়েছে গাজা যুদ্ধে এই অঞ্চলে কমপক্ষে ৪৮ হাজার ২১৯ জন নিহত হয়েছে। এটি জাতিসংঘের মতে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান। মঙ্গলবার জারি করা জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা পুনর্নির্মাণ এবং বিধ্বস্ত অঞ্চলে ‘মানবিক বিপর্যয়’ শেষ করতে ৫৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।
সূত্র: আল জাজিরা, এএফপি
এসজেড