ঢাকা | বঙ্গাব্দ

সাবেক সমন্বয়কদের নেতৃত্বেই আত্নপ্রকাশ করছে নতুন ছাত্রসংগঠন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে নতুন একটি ছাত্রসংগঠন আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
সাবেক সমন্বয়কদের নেতৃত্বেই আত্নপ্রকাশ করছে নতুন ছাত্রসংগঠন ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে নতুন একটি ছাত্রসংগঠন আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, যার সম্ভাব্য নাম ‘বিপ্লবী ছাত্রশক্তি’। এই সংগঠনের নেতৃত্বে থাকছেন আগে কার্যক্রম স্থগিত হওয়া ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র সাবেক নেতারা। এছাড়া, সংগঠনটিতে যুক্ত হচ্ছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষার্থীরা এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কিছু শিক্ষার্থী।


সংগঠনটির সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত থাকা কিছু শিক্ষার্থীও থাকছেন, তবে কোনো পদধারী শিবির নেতা এতে যুক্ত হচ্ছেন না। সংগঠনটির চারজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।


গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির সমন্বয়কদের বড় অংশই ছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতা। আন্দোলনের প্রথম পর্বে, ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত, কোটা সংস্কারের দাবিতে আয়োজিত আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখার নেতা-কর্মীদের অনেকেও অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ সে সময় ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন।


এদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাও অংশ নিয়েছিলেন। তবে সংগঠনের প্রকাশ্য কার্যক্রম না থাকায় তখন তাঁরা নিজেদের সাংগঠনিক পরিচয় সামনে আনেননি।


সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন ছাত্রসংগঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে চারজন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে। হলে ওঠা, আসন পাওয়া—সব কিছুই ছাত্রলীগের নেতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত। হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে মিছিল, সমাবেশসহ ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়েছে।


এ ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে, যারা অতীতে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না, তারা নতুন সংগঠনে যুক্ত হতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান ওরফে জিমের কথা উল্লেখ করেছেন উদ্যোক্তারা। আশিকুর ছিলেন ছাত্রলীগের সূর্য সেন হল শাখা কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে তিনি প্রথম ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তাঁর মতো অনেকেই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তখন ছাত্রলীগের পদ ছেড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি থেকে পদত্যাগ করা নেতাদের সংখ্যা দুই শতাধিক বলে জানা গেছে।


কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যেসব শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ থেকে সরে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই কোনো পদে ছিলেন না, তবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। উদাহরণস্বরূপ, সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী লিমন মাহমুদ হাসান এবং অমর একুশে হলের মহির আলম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মতো অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ ছেড়ে নতুন সংগঠনে যোগ দিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীদেরও নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত করার আগ্রহ রয়েছে উদ্যোক্তাদের।


গণ–অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, নতুন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নতুন ছাত্রসংগঠনের কোনো যোগসূত্র থাকবে না। তবে গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাদের কিছু অংশ নতুন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হচ্ছেন এবং বাকিরা নতুন ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসছেন।


নতুন ছাত্রসংগঠন ও নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের পরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বহাল থাকবে। বিষয়টি এই দুই প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রীয় নেতারা এর আগে একাধিকবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।


আলোচনায় আবার ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’


গণ–অভ্যুত্থানের পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করে, এর পরেই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সকল কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে নতুন যে ছাত্রসংগঠন আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, তার উদ্যোক্তারা মূলত ছাত্রশক্তির সাবেক নেতা।


ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন, ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে একদল নেতা-কর্মী ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের প্রায় সবাই ছিলেন ছাত্রশক্তির নেতা। সংগঠনের দুই নেতা নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


এছাড়াও, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সাবেক নেতারা—আবু বাকের মজুমদার, আবদুল কাদের, হাসিব আল ইসলাম, সানজানা আফিফা অদিতি—গণ–অভ্যুত্থানের সময় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাঁরা নতুন ছাত্রসংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন।


যাদের নিয়ে আলোচনা:


নতুন ছাত্রসংগঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সাবেক সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পালন করবেন আবু বাকের মজুমদার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন।


কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসচিব পদে আলোচনায় আছেন সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলের সম্পাদক জাহিদ আহসান এবং সাবেক সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী। তাঁরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তবে সদস্যসচিবের পদে কার নাম চূড়ান্ত হবে, সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।


জাহিদ এবং তাহমিদের মধ্যে যিনি সদস্যসচিব পদে নির্বাচিত হবেন না, তিনি নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানা গেছে। নতুন সংগঠনের মুখপাত্র পদের জন্য আলোচনায় আছেন আশরেফা খাতুন ও রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, যাঁরাও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আশরেফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী, আর রাফিয়া ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।


নতুন ছাত্রসংগঠনের উদ্যোক্তারা জানান, সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে আলোচনায় এসেছিলেন কাদের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব পদের জন্য আলোচনায় আছেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মহির আলম ও লিমন মাহমুদ হাসান। তাঁরা একসময় ছাত্রলীগের (কোনো পদে ছিলেন না) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।


এছাড়া নতুন ছাত্রসংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখ্য সংগঠক পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাসিব আল ইসলাম ও রিফাত রশীদ। মুখপাত্র পদের জন্য আলোচনায় আছেন রাফিয়া রেহনুমা। এই তিনজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। তাঁরা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তিরও নেতা ছিলেন।


উদ্যোক্তারা জানান, নতুন ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি একসঙ্গে ঘোষণা করা হবে, এবং আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ দু-এক দিনের মধ্যে ঘটতে পারে। এই ছাত্রসংগঠনের মূল নীতি হবে 'স্টুডেন্টস ফার্স্ট' এবং 'বাংলাদেশ ফার্স্ট', এবং তারা ছাত্র-নাগরিকের স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে কাজ করবে।


নতুন ছাত্রসংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক রেজওয়ান আহমেদ রিফাত বলেন, নতুন সংগঠন কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না এবং কোনো ‘মাদার পার্টির’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না। সংগঠনটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতা নির্বাচিত করবে।



thebgbd.com/NA