ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাদানুবাদ! ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এ আচরণে রাগে ফুঁসছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, শান্তির খোঁজে বসা নিষ্ফলা ওই বৈঠকের কারণে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে বাঁক নিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে ‘অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু’ পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ।
২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাদানুবাদের ছবি প্রত্যক্ষ করে গোটা দুনিয়া। বচসার কিছুক্ষণের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’ ছেড়ে বেরিয়ে যান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ঘটনাটি জানাজানি হতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিতীয় প্রধান এবং নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির কর্তাব্যক্তি কাজা কালাস।
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকের পর এক্স-এ কালাস লেখেন, ‘আজ এটা প্রমাণিত, ‘মুক্ত বিশ্ব’ তৈরি করার জন্য নতুন নেতার প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের অর্থাৎ ইউরোপীয়দেরই গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইউক্রেন হল ইউরোপ। আমরা সব সময়ে কিয়েভকে সমর্থন করে যাব যাতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।’
এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে কালাস অবশ্য সুনির্দিষ্ট করে ট্রাম্প বা যুক্তরাষ্ট্রের নাম করেননি। ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা কী ভাবে ঠিক হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে এ ব্যাপারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ পদাধিকারীর এ মন্তব্যে অবশ্য সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাদের কথায়, ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের পর জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো ত্যাগ করলে ইউরোপের নিরাপত্তা যে প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর চার বছরের মধ্যেই মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো) গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩২। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রায় সাড়ে চার দশক যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে পুরোপুরি থেমে যায় ওই ঠান্ডা লড়াই। বিশ্লেষকদের দাবি, এর র থেকেই ইউরোপের দেশগুলি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
কিন্তু, এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে এই নীতিতে বদল এনেছেন ট্রাম্প। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ফি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে রাজি নন তিনি। এর জন্য প্রয়োজনে ন্যাটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
ট্রাম্প যে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নন, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো শক্তিশালী দেশগুলি। আর তাই এই কাজে নেতৃত্ব দিতে নতুন নেতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন জার্মানির পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যান্সেলর তথা মধ্য-ডানপন্থী ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ান পার্টি’র নেতা ফ্রেডরিখ মার্জ। তার কথায়, ‘ইউরোপকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে নিরাপত্তার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।’
আসছে জুনে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের সদর দপ্তরে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। সেখানে এ ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সম্ভাব্য জার্মান চ্যান্সেলর মার্জ। ‘জুনের সম্মেলনেই ন্যাটোর রূপ বদলের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে।’ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন তিনি।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এককাট্টা, তা নয়। উদাহরণ হিসাবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল মাক্রোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কথা বলা যেতে পারে। এখনই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাদের। আর সে কথা খোলাখুলি ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে একটি অভিনব পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ইউরোপ, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একটি বিবৃতিতে মেলোনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে আলোচনার রাস্তা নিতে হবে। ইউক্রেনকে রক্ষা করতে হলে দেরি না করে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বন্ধু’দের কথা বলা উচিত।’
ইটালির প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ট্রাম্প মেনে নেবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্য দিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর আরবান আবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার জন্য জেলেনস্কিকেই দুষেছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাই আপাতত অনড় না থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারত।’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিন বছর পেরিয়ে যুদ্ধ থামার নামগন্ধ না নেওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে শান্তি সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার সময়েই মেজাজ হারান দুই রাষ্ট্রনেতা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই কিয়েভকে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র। বৈঠকে সে সব পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। কিন্তু তাতেও আগাগোড়া অনড় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এমনকি বৈঠক শেষে নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নেও সাফ ‘না’ বলে দেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমের সামনেই পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকে দায়ী করে ট্রাম্প বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়ায় বসেছেন তিনি। তাই সমঝোতা চাইছেন না।’ এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতার সামনে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করলেন ট্রাম্প। তার কথায়, ‘শান্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। এর জন্য আপসের প্রয়োজন রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ না হলে কিয়েভের সঙ্গে থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ হুঁশিয়ারিকে অত্যন্ত তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।
বৈঠক ভেস্তে পাওয়ার পর ইউক্রেনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ব্রিটেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিয়েভকে ২৮০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করছেন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। ফলে আগামী দিনে লড়াই আরও ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কির পররাষ্ট্রনীতি কোন খাতে বয়ে চলে, সেটাই এখন দেখার।
সূত্র: রয়টার্স
এসজেড