ঢাকা | বঙ্গাব্দ

বহু পুরোনো ‘শত্রুতা’

মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনের প্রতি বিদ্বেষের নেপথ্যে কিন্তু রয়েছে একাধিক কারণ।
  • অনলাইন ডেস্ক | ০৩ মার্চ, ২০২৫
বহু পুরোনো ‘শত্রুতা’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ঐতিহ্যশালী দপ্তরটি জনপ্রিয় ওভাল অফিস নামে। সেখানেই শান্তি সমঝোতা এবং খনি চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পাশাপাশি বসেন ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। ২১ শতকের ক্যালেন্ডারে এই তারিখটা লাল অক্ষরেএ লেখা থাকবে কিনা, তা ঠিক করবেন ভবিষ্যতের কোনও ইতিহাসবিদ। কারণ, ওই দিনেই শান্তি সমঝোতা ও খনি চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনার সময়ে এক ঝাক সংবাদমাধ্যমের সামনে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান দুই প্রেসিডেন্ট। 


ভেঙে যায় যাবতীয় শিষ্টাচারের বিধিনিষেধ। লাটে উঠে শান্তি সমঝোতা ও খনি চুক্তি। বৈঠক চলাকালীনই মেজাজ হারান দুই প্রেসিডেন্ট। পুরোটাই ক্যামেরাবন্দি করেন সেখানে হাজির সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। তাৎক্ষণিক রাগের বহিঃপ্রকাশ? নাকি বিবাদের শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে সম্পর্কের গভীরে? বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ব্যক্তিগত ভাবে ইউক্রেনকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আরও স্পষ্ট করে বললে, জেলেনস্কিকে একরকম ঘৃণাই করেন তিনি। প্রথম দিকে কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক এমন ছিল না। কিন্তু সময়ের চাকা গড়াতেই বদলে যায় গোটা পরিস্থিতি। ট্রাম্পের ইউক্রেন বা জেলেনস্কি বিদ্বেষের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।


বিরোধের সূত্রপাত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। ওই সময়ে জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলে বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতার বিরুদ্ধে ওঠে ভোট প্রভাবিত করার অভিযোগ। এর জন্য তিনি ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে কাজে লাগিয়েছেন বলে ব্যাপক প্রচার শুরু করে দেন বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা। ফলে ভোটে হার হয় ট্রাম্পের। কিন্তু পুরো সময়ে নির্বাক ছিলেন জেলেনস্কি।


তারও আগে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। সেবারই প্রথম ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন ট্রাম্প। ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে আনা হয় ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব। যদিও তাতে তেমন লাভ হয়নি। প্রেসিডেন্ট হিসাবে চার বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন তিনি। পরবর্তী কালে তদন্তে জানা যায়, ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা ছিল কিয়েভের মস্তিষ্কপ্রসূত। ফলে ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের ঘৃণা বাড়তে শুরু করে।


২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারে দায়িত্বে ছিলেন পল মানাফোর্ট। একটা সময়ে ইউক্রেনের সাবেক রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের হয়ে কাজ করতেন তিনি। কিয়েভকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে দূরে রেখেছিলেন তিনি। মস্কোর প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের জেরে ভিক্টরের উপর আমজনতার ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশে ছেড়ে চম্পট দেন তিনি।


ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে যেতেই তার দলের সদর দপ্তরে অগ্নিসংযোগ করে উন্মত্ত জনতা। সেখান থেকে হাতে লেখা ‘ব্ল্যাক লেজার’ নামের একটি ছোট ডায়েরি উদ্ধার হয়। তাতে একাধিক বার মানাফোর্টের নাম লেখা এবং নামের পাশে অন্তত ২২ বার ১.২৭ কোটি ডলার নিয়েছেন বলে উল্লেখ ছিল। ওই অর্থ ট্রাম্পের প্রচারে খরচ করার অভিযোগ ওঠে। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেন মানাফোর্ট।


২০১৬ সালের অগস্টে এই খবর ফলাও করে প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তখন আর বাকি মাত্র তিন মাস। সে বছর ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের স্ত্রী ডেমোক্র্যাটিক নেত্রী হিলারি। এই ইস্যুতে তিনিও রিপাবলিকান নেতাকে খোঁচা দিতে ছাড়েননি। ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হলেও রাশিয়ার থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ তাড়া করে বেড়িয়েছে ট্রাম্পকে। আর এর জন্য ইউক্রেনকেই দায়ী করেন তিনি।


২০১৭ সালে অর্থ পাচার এবং কর ফাঁকি-সহ মোট ১২টি মামলায় অভিযুক্ত হন মানাফোর্ট। এগুলির সঙ্গে অবশ্য ‘ব্ল্যাক লেজার’-এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। তবুও ‘পাপের ভাগীদার’-এর মতো কটাক্ষ হজম করতে হয় ট্রাম্পকে। গত বছরের মার্কিন নির্বাচনে আবারও নাক গলানোর অভিযোগ ওঠে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। এতে আরও চটে যান যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট।


২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাটিক দলের নেত্রী কমলা হ্যারিস। জেলেনস্কি তার হয়ে প্রচার পর্যন্ত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইউক্রেন অবশ্য এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, নির্বাচনে জেলেনস্কির কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করা ছাড়া দ্বিতীয় রাস্তা খোলা ছিল না। কারণ, ভোটের প্রচারেই ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন, ক্ষমতায় ফিরলে ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার দেওয়া বন্ধ করবেন তিনি। ফলে আতঙ্কিত ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট কমলাকে জেতাতে মরিয়া ছিলেন।


জেলেনস্কির উপর ট্রাম্পের রাগের সর্বশেষ কারণ হল আর্থিক কেলেঙ্কারি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, তিন বছরে ইউক্রেনকে ৩০ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে মার্কিন সরকার। কিন্তু এই অঙ্ক মানতে নারাজ কিয়েভ। জেলেনস্কির দপ্তর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১০ হাজার কোটি ডলারের কোনও হিসাব জানা নেই তাদের। ওই প্রতিক্রিয়ার পর আরও জ্বলে ওঠেন ট্রাম্প।


মার্কিন প্রেসিডেন্টের কিভের প্রতি মনোভাব নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেন ইউক্রেনীয় মার্কিন শিল্পপতি লেভ পার্নাস। তার কথায়, ‘ট্রাম্প ইউক্রেনকে ঘৃণা করেন। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা মনে করেন কিয়েভের জন্যেই যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই তার থেকে জেলেনস্কির কিছু আশা না করাই ভাল।’


ট্রাম্পের শরীরী ভাষায় ইউক্রেন-বিদ্বেষের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময়ে জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরাচারী’ এবং ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে কটাক্ষ করেন। ২০২৪ সালে ইউক্রেনে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও যুদ্ধের কারণে সেটা হয়নি। ফলে প্রেসিডেন্ট রয়ে গেছেন জেলেনস্কি। এটা মানতে নারাজ ট্রাম্প। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, জেলেনস্কিকে দ্রুত প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরাতে চাইছেন ট্রাম্প। পূর্ব ইউরোপে শান্তির জন্য এটা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা ‘সিআইএ’কে যাবতীয় ছাড়পত্র দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।


বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে ভুলই করেছেন জেলেনস্কি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনও কিছু ভুলে যান না এবং কাউকে সহজে ক্ষমাও করেন না। এরইমধ্যে কিয়েভকে পাঠানো সাহায্য বন্ধ করেছেন তিনি। ফলে ভবিষ্যতে মস্কোর সঙ্গে লড়াই জেলেনস্কির পক্ষে যে কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য।


সূত্র: ব্লুমবার্গ


এসজেড