গণজাগরণ মঞ্চের পরিচিত মুখ লাকি আক্তার। ২০১৩ সালে শাহবাগে নানা স্লোগান দিয়ে দেশজুড়ে পরিচিতি পান তিনি। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি সেই লাকী আবারও আলোচনায় এলেন দীর্ঘ এক যুগ পর। এবার অবশ্য ঠিক একটা সুবিধা করে উঠতে পারলেন না তিনি। রাজপথে নেমেই পড়েছেন তীব্র রোষের মুখে।
গতকাল মঙ্গলবার (১১ মার্চ) সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করতে গেলে পথে পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়। এসময় লাকী আক্তারের নির্দেশে পুলিশের ওপর হামলা চালান সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সেইসব ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় হয় ভাইরাল। যার প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
রাতেই লাকী আক্তার এবং তার নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল নামে। ওঠে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি। এছাড়াও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সূচনাকারীদেরও গ্রেপ্তারের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
লাকী আক্তারকে গ্রেপ্তার দাবিতে রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবি। মধ্য রাতে ঢাবির বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ২০১৩ সালের শাহবাগীদের নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে জড়ো হচ্ছে টিএসসি এলাকায়।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শাহেদ ইমন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, যখন ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে আমরা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, ঠিক তখনই শাহবাগীরা ষড়যন্ত্র করতে নেমে এসেছে। যেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আনা হয়েছিল, সেই সংস্কৃতি মাড়িয়ে আমরা শাহবাগীদের বিচার করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। হয় শাহবাগীরা থাকবে, না হয় আমরা দেশের আমজনতা থাকব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণঅভ্যুত্থান মঞ্চ থেকে গতকাল রাত দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সড়ক ও আবাসিক হল প্রদক্ষিণ শেষে একই জায়গায় এসে মিলিত হোন।
এসময় গণঅভ্যুত্থান মঞ্চের সদস্য সচিব ইকরামুল হক মামুন লাকীর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা এই শাহবাগীদের বাংলাদেশের মাটিতে থাকতে দেবো না। আমাদের রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের থেকে দেশ মুক্ত করবো। আমরা তাদের বাংলার জমিনে উত্থান ঘটতে দেবো না।
লাকী আক্তারকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও (চবি)। মঙ্গলবার রাত ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে জিরো পয়েন্টে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
এসময় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, যতদিন জুলাই যোদ্ধারা জেগে থাকবে ততদিন ১৩ এর শাহবাগ ফেরত আসতে পারবে না। যতবার লাকীরা ফেরত আসার চেষ্টা করবে ততবার জুলাই ফিরে আসবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, তোমরা বোনদের ধর্ষণকে কেন্দ্র করে যে নোংরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছো তা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ রুখে দেবে।
লাকী আকতার প্রসঙ্গে মুখ খুলতে শুরু করেছেন শীর্ষ পর্যায়ের অনেক ছাত্র নেতারাও। ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম বলেছেন, বাংলাদেশপন্থী ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের মধ্যে তৈরি হওয়া বিভাজনের সুযোগ নিচ্ছে দেশবিরোধী শক্তি। তারাই শাহবাগের বিচারহীনতা ও ফ্যাসিবাদের আইকন লাকি আক্তারকে পুনর্বাসন করছে।
তিনি আরও বলেন, শাহবাগের মাধ্যমেই হাসিনার ফ্যাসিজমের উত্থান এবং পূর্ণতা। লাকিরা ছিলো আওয়ামী লীগের চেতনা ব্যবসার ইনভেস্টমেন্ট ও রক্ষাকবচ। শাহবাগের মবোক্রেসিই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেশপ্রেমিক নেতাদের শহীদ করেছে। শহীদ করেছে প্রতিবাদী নাগরিক, উলামা, হুফফাজ ও কারীদের। সেই জায়গায় শাহবাগের পুনর্বাসনের কোনো প্রশ্নই উঠে না। যেকোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ইনকিলাব জিন্দা রাখতে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
জুলাইয়ের যে প্রজন্ম ফ্যাসিবাদ, মুজিববাদ, শাহবাগীতার পতন ঘটিয়েছে, সেই প্রজন্ম যেকোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করবে না, যোগ করেন তিনি।
ছাত্রশিবিরের বর্তমান সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিচার চাই না, ফাঁসি চাই’, এই থিওরির মাধ্যমেই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল শাহবাগী গোষ্ঠী। তারা আদর্শিক হেজেমনি দিয়ে দেশে ইসলামোফোবিয়া এবং আবহমান সম্প্রীতির সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। হাসিনাকে ‘গডমাদার অব ফ্যাসিজম’ হিসেবে তৈরি করেছে।
ছাত্রশিবির সভাপতি আরও লেখেন, শাপলা গণহত্যা ও আল্লামা সাঈদীর রায়ের প্রেক্ষিতে গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল এরাই। শাহবাগে তৈরিকৃত ফ্যাসিবাদী পাটাতনে দাঁড়িয়ে হাসিনা জুলাইসহ যত গণহত্যা চালিয়েছে এর দায় অবশ্যই এদেরকে নিতে হবে। আমরা ফ্যাসিবাদের দালালদের ন্যায় বিচার চাই।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও এই লাকী আক্তার এবং শাহবাগ নিয়ে মুখ খুলেছেন। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ২০২৫ এ এসে ২০১৩ ফেরানোর চেষ্টা করবেন না।
thebgbd.com/NIT