ঢাকা | বঙ্গাব্দ

এগিয়ে চলেছেন শাম্মি নাসরিন

২০২৩ এ মালয়েশিয়াতে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতাতে, দেশের হয়ে ব্রোঞ্জ মেডেল অর্জন করেছেন।
  • অনলাইন ডেস্ক | ১৯ মার্চ, ২০২৫
এগিয়ে চলেছেন শাম্মি নাসরিন নিজের কয়েকটি পদক নিয়ে শাম্মি নাসরিন।

শাম্মী নাসরিনের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙা গ্রামে। শৈশব কেটেছে গ্রামে, এসএসসি পর্যন্ত গ্রাম থেকেই। টিনেজ বয়সেই ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলেন। এরপর স্বামী, সংসার ও সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পড়াশোনায় ভাটা পড়ে।


২০১৯ সালে প্রথমবারের মত পাওয়ারলিফ্টিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ভালো লেগে যাওয়ায় তারপর থেকে প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। ২০২৪ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের মধ্যে তিনবার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।


এ ছাড়াও প্রতি বছরই অন্যান্য যেসব প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্ট হয়, তার প্রায় সবগুলোতে তিনি অংশগ্রহণ করে আসছেন এবং ভালো ফলাফল অর্জন করে চলেছেন। এর মাঝে ২০২২ সালে বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করেছেন।


২০২৪ সালে দেশের পাওয়ারলিফ্টিং ইভেন্ট এ “গার্লস পাওয়ার” নামে একটা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সব ক্যাটাগরি এর মেয়েদের মধ্যে “গার্লস পাওয়ার” অ্যাওয়ার্ডটা তিনি অর্জন করেছেন। ২০২৩ এ মালয়েশিয়াতে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতাতে, দেশের হয়ে ব্রোঞ্জ মেডেল অর্জন করেছেন। দেশের অন্য প্রতিযোগিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র মেডেল অর্জন করেন।


সুস্থ থাকলে এবং সবার দোয়া ও সহযোগিতা পেলে হয়তো আরও ভালো কিছু অর্জন করার আশা রাখেন শাম্মি। বর্তমানে পরিবার নিয়ে তিনি থাকছেন ঢাকার মিরপুর-২ তে। পাশাপাশি মিরপুর ১২তে একটি স্বনামধন্য জিমে ট্রেইনার হিসেবে কাজ করছেন। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সেখানে মেয়েদের শরীরচর্চা এবং সব ধরনেরই ট্রেইন পরিচালিত হচ্ছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে চারজন মেয়ের ট্রেইনের দায়িত্বে আছেন।


বেঙ্গল গেজেট” এর পক্ষ থেকে আমরা রমজানের মধ্যেই কথা বলেছি এই গুণি খেলোয়ারের সঙ্গে। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেই তিনি সময় করে আমাদের ছোট একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।


বেঙ্গল গেজেট) পাওয়ারলিফ্টিং করবেন, এই বিষয়টা মাথায় কবে আসলো, কিভাবে আসলো?


শাম্মি : আমাদের দেশে পাওয়ারলিফ্টিং এর শুরু কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। বিশ্বে দারুন জনপ্রিয় এই প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্ট আমাদের দেশে শুরু হয় ২০১৮ তে। জিম রিলেটেড দুইটা ইভেন্ট হয় সাধারণত। তার মধ্যে পাওয়ারলিফ্টিং ও বডিবিল্ডিং অন্যতম। মূলত সুস্থ থাকার জন্য জিম করা শুরু করি। কিন্তু অন্যদের দেখে এবং ট্রেইনারের পরামর্শে ওয়েট নেওয়া শুরু করি। তখন আমার জিম এর মালিক এবাদত হোসেনের (রানিং মি: বাংলাদেশ) পরামর্শে পাওয়ারলিফ্টিং-এ অংশ নেই। এভাবেই পাওয়ারলিফ্টিং-এর ভুবনে হাটি হাটি পা পা করে আমার পথচলা শুরু।


বেঙ্গল গেজেট) বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভে, এই বয়সে এই ধরনের একটা প্রতিযোগিতামূলক খেলায় যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা কতটা কঠিন ছিল? বা আদৌ কোনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছেন কী? হলে সেই চ্যালেঞ্জগুলো কেমন ছিল?


শাম্মি : যখন জিম শুরু করি তখন সুস্থ থাকাটাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। শারীরিক নানা জটিলতার মধ্যে ছিলাম। পরে আস্তে আস্তে সেগুলো কাটিয়ে উঠলাম। তখন অনেক জিমেই মেয়েদের জন্য ভালো ফ্যাসিলিটি ছিল না। অনেক জিমেই মেয়েদের জন্য আলাদা করে ফিক্সড ২-৩ ঘন্টা সময় বেঁধে দেওয়া হতো। এখন অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখনও পুরুষশাষিত এই সমাজ মেয়েদের জিম করাটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারে না।


বেঙ্গল গেজেট) প্রথমদিকে পরিবারের সাপোর্ট কেমন পেয়েছেন? কোনও ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?


শাম্মি : প্রথমদিকে আমার বড় ছেলে আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। আসলে প্রতিটা খেলার একটা পোশাক বা কস্টিউম থাকে। আমার স্বামীর সেটাতে সমস্যা ছিলো। তার সেটা মেনে নিতে সময় লেগেছে।


বেঙ্গল গেজেট) জিম বা অন্যান্য ট্রেনিং সংক্রান্ত আপনার দৈনন্দিন রুটিনটা যদি একটু বলেন।


শাম্মি : আসলে নিজের পরিবারের সব কাজ নিজেই করতে পছন্দ করি। আগামীকাল যেই কাজ গুলো করবো সেই কাজ গুলো কিভাবে করবো সেইটার পরিকল্পনা আগেই করে রাখি। ভোরে উঠে নিজের নাস্তা করে পরিবারের সবার খাবার তৈরি করে ফেলি। তারপর দুপুর দু’টা নাগাদ জিমে উপস্থিত হয়ে যাই। প্রথমে নিজের ট্রেনিং সেশন শেষ করে রাত দশটা পর্যন্ত অন্যদের ট্রেনিং করাই।


বেঙ্গল গেজেট) শুধু নিয়মিত এক্সসাইজ বা ট্রেনিংই যথেষ্ঠ নয়, একটা নির্দিষ্ট ডায়েট চার্টও ফলো করতে হয় কঠিন ভাবে। পাশাপাশি খাওয়া দাওয়া বা লাইফ স্টাইলও একটা স্ট্রিক্ট নিয়মের মধ্যে আনতে হয়। একজন ফ্যামিলি পারসন হিসেবে সেই ধরনের চার্ট মেনে চলা, স্ট্রিক্ট নিয়মের মধ্যে থাকা কতোটা কষ্টসাধ্য? 


শাম্মি : সব সময় একটা রুটিন মাফিক চলার চেষ্টা করি, তারপরও যদি কিছু কমতি থেকে যায় তাহলে কথা শুনতেই হয়। নিয়ম করে আমার খাবার রেডি করি। আমার যা খাবার বা শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখতে যা খাই পরিবারের অন্যরা সেটা খেতে চায় না। তাই তাদের জন্য আলাদা করে খাবার তৈরি করা লাগে। কষ্ট তো একটু হয়, সত্যি বলতে কষ্ট ছাড়া কিছুই সম্ভব না।


বেঙ্গল গেজেট) বর্তমান সময়ে বডিবিল্ডিং এর অন্যতম সহযোগী বিষয় প্রোটিন শেক। এটা কতটুকু উপকার করে? যদি আপনি ব্যবহার করেন তো আপনার ক্ষেত্রে এটা কতটুকু করেছে বলে মনে করেন।


শাম্মি : প্রোটিন আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা শরীরচর্চা করি না, তাদেরও উচিত প্রতিদিন প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া। একজন মানুষের উচিত শরীরের ওজন যতো কেজি ঠিক ততো গ্রাম প্রোটিন প্রতিদিন খাওয়া। আর যারা অ্যাথলেট তাদের উচিত দ্বিগুণ খাওয়া। ন্যাচারালি এতো প্রোটিন খাবার থেকে নেওয়া কঠিন, তাই ফুড সাপ্লিমেন্ট খেতে হয়। আমাকেও খেতেই হয়, কিন্তু সেটা একটু দামি দেখে সব সময়ে হয়তে সম্ভব হয়ে ওঠে না। একজন মা হিসেবে আমাকে সবার কথা, সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করতে হয়।


বেঙ্গল গেজেট) আজকাল প্রায় সবাই, নিজের শরীরচর্চা বিভিন্ন রিলসের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিচ্ছেন। বিষয়টা কিভাবে দেখেন? আপনি কেন দিচ্ছেন না?


শাম্মি : খুব কম ভিডিও আপলোড করি। কারণ মানুষ বিভিন্নভাবে সমালোচনা করে। তাছাড়া আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব একটা এক্সপার্টও না। তারপরও আমার পেজ আছে, সামনে হয়তো আরেকটু বেশি ভিডিও আপলোড করবো।


বেঙ্গল গেজেট) এই সময়ে অনলাইন ট্রল প্রায় সবারই নিত্যসঙ্গী, বিষয়টা কিভাবে দেখেন?


শাম্মি : অনলাইন ট্রল বা ওহেতুক বুলি করাটা একদম পছন্দ করি না। আমাকেও মানুষ বিভিন্ন মন্তব্য করে। কিন্তু সেগুলো পাত্তা দেই না। কারণ চলার পথে ওগুলো খুব সামান্য বাঁধা। ওগুলো নিয়ে ভাবলে সামনে এগুনো যাবে না।


বেঙ্গল গেজেট) মেয়েদের শরীরচর্চার হার দেশে তো বটেই, রাজধানীতেও অনেক কম। মেয়েদের এইক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণগুলো কী কী বেলে আপনার ধারণা।


শাম্মি : মেয়েদের জিম করা বা শরীরচর্চা কম করার অন্যতম কারণ হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে বেশ পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত মানুষও পুরোনো চিন্তা ধারার যেটা সহজ ভাবে বললে বলবো কনজারভেটিভ মাইন্ডেড। যার জন্য মেয়েরা আজও ঘরের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি। শুধু শরীরচর্চা না আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন মেয়েরা সব দিকেই পিছিয়ে আছে।


বেঙ্গল গেজেট) পাওয়ারলিফ্টিং নিয়ে বিদেশ সফর করেছেন, পার্থক্য কেমন দেখেছেন। আমাদের মেয়েরা কতটা পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন এবং কেন।


শাম্মি : অনেক পিছিয়ে আছেন। অনেক বেশি ইমপ্রুভমেন্ট দরকার। তবে আমি মনে করি আমাদের দেশের মেয়েদের সেই যোগ্যতা আছে যে তারা চাইলে বেশ ভালো কিছু করতে পারে।


বেঙ্গল গেজেট) পাওয়ারলিফ্টিং নিয়ে ভবিষ্যত ভাবনা কী? বা ভবিষ্যত পরিকল্পনাটাও যদি একটু বলতেন।


শাম্মি : এই পাওয়ারলিফ্টিং খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্যই আমাকে এখন এতো মানুষ চিনেন এবং সম্মান করেন। তাই এই খেলার প্রতি এবং পাওয়ারলিফ্টিং ফেডারেশনের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আর হয়তো দুই বা তিন বছর খেলা চালিয়ে অবসর গ্রহণ করবো। এরপর ইচ্ছা আছে, দেশের মেয়েদের এই খেলায় পারদর্শী করতে ফেডারেশন এর সঙ্গে মিলে কাজ করতে চাই। অবশ্য যদি তারা আমাকে সেই যোগ্য মনে করেন তবেই।


বেঙ্গল গেজেট) আপনার পরিবার, সদস্যদের সম্পর্কে কিছু বলুন।


শাম্মি : স্বামী দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার পরিবার। যদিও এখন দুই ছেলে বিদেশে থাকে। আমার পরিবার আমাকে যথেষ্ট প্রেরণা দেয়, যার জন্য আরও বেশি সাহস পাই আমার স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলার।


পরিশেষে শাম্মি নাসরিন, তার ও তার পরিবারের সবার জন্য পাঠকদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। এবং “বেঙ্গল গেজেট” এর মাধ্যমে সবাইকে আসন্ন ঈদের জন্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়েছেন। 


এসজেড