নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট প্রেভোস্ট। তিনি ইতিহাসের প্রথম মার্কিন পোপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তার পোপীয় নাম হবে ‘পোপ চতুর্দশ লিও’। পেরুতে মিশনারি কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ক্যাথলিক চার্চের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাঠামোতেও গভীর বোঝাপড়ার অধিকারী।
ভ্যাটিকান সিটি থেকে এএফপি জানায়, ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলের ওপর থেকে সাদা ধোঁয়া উড়েছে বৃহস্পতিবার, এটি ইঙ্গিত দেয়. চ্যাপেলের ভেতরে ১৩৩ জন কার্ডিনাল একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে নতুন পোপ নির্বাচন করেছেন। ভোটের দ্বিতীয় দিনেই পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি নির্বাচিত হলেন।
শিকাগোতে জন্ম নেওয়া নতুন পোপ লিও চতুর্দশকে তার পূর্বসূরি পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের অন্যতম ক্ষমতাধর দপ্তর ‘ডিক্যাস্ট্রি ফর বিশপস’-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এই দপ্তর বিশ্বজুড়ে নতুন বিশপ নিয়োগের বিষয়ে পোপকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। প্রেভোস্টকে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়, ফ্রান্সিস তার ‘পেরিফেরি’—রোম থেকে দূরের প্রান্তিক অঞ্চল—কেন্দ্রিক মিশনারি কর্মকাণ্ডকে কতটা গুরুত্ব দিতেন এবং প্রেভোস্টকে মধ্যপন্থী ও সেতুবন্ধনকারী এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতেন।
৬৯ বছর বয়সী প্রেভোস্ট পেরুর চিকলায়ো অঞ্চলের আর্চবিশপ-বিশপ ছিলেন। ২০২৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন এবং ‘ডিক্যাস্ট্রি ফর বিশপস’-এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। এই পদ তাকে চার্চের অভ্যন্তরীণ সকল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ দেয়।
৬৯ বছর বয়সী রবার্ট প্রেভোস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন দক্ষিণ আমেরিকায় খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে কাজ করেছেন এবং পেরুতে বিশপ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি ভ্যাটিকানে বিশপ নিয়োগ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের প্রধান ছিলেন। পোপ ফ্রান্সিসের গৃহীত সংস্কারগুলো তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিকরা নতুন পোপ নির্বাচনের দিকে নজর রাখছিলেন। প্রথম যেসব কাজ পোপকে করতে হয়, তার মধ্যে রয়েছে গির্জার অভ্যন্তরীণ একতা রক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার ও বিশ্ব রাজনীতিতে নৈতিক নেতৃত্ব প্রদান। ভ্যাটিকান বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কার্ডিনালদের মধ্যে পোপ হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল প্রেভোস্টেরই—তার যাজকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, বৈশ্বিক দৃষ্টি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে।
ইতালির পত্রিকা লা রেপুবলিকা তাকে ‘আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে কম আমেরিকান’ বলে অভিহিত করেছে—তার নম্র স্বভাবের জন্য। ক্যানোন আইন বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান চার্চের রক্ষণশীল পক্ষ, যারা ধর্মতত্ত্বকেন্দ্রিক মনোযোগ চান, তাদের কাছে আশাব্যঞ্জক বলে বিবেচিত হয়েছে।
কনক্লেভ ও নতুন পোপ নির্বাচন
পোপের মৃত্যুতে শুরু হয় ‘সেদে ভাকান্তে’ বা ‘পবিত্র আসন শূন্য’ পর্ব। এরপরই আহ্বান করা হয় গোপন কনক্লেভ—যেখানে ৮০ বছরের নিচের বয়সী ১৩৩ জন কার্ডিনাল সিস্টিন চ্যাপেলে মিলিত হন পোপ নির্বাচনের জন্য। চার দিনের কনক্লেভ শেষে মার্কিন নাগরিক রবার্ট প্রেভোস্ট নির্বাচিত হন। তিনি এখন থেকে পোপ চতুর্দশ লিও নামে পরিচিত হবেন।
‘পেছনে ফেরার সময় নয়'
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর প্রেভোস্ট বলেন, চার্চের অনেক কাজ এখনও বাকি। তিনি বলেন, ‘থেমে থাকতে পারি না, পেছনে ফিরতে পারি না। দেখতে হবে, আজ এবং আগামীর পৃথিবীতে পবিত্র আত্মা চার্চকে কেমন দেখতে চান। কারণ বর্তমান পৃথিবী দশ বা কুড়ি বছর আগের মতো নয়। বার্তাটি একই—যিশু খ্রিষ্ট ও তার সুসমাচার প্রচার। কিন্তু আজকের মানুষের, তরুণদের, দরিদ্রদের এবং রাজনীতিকদের কাছে পৌঁছানোর পদ্ধতিটা আলাদা।’
১৯৫৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর শিকাগোতে জন্মগ্রহণকারী প্রেভোস্ট সেন্ট লুইসে সেন্ট অগাস্টিন অর্ডারের একটি মাইনর সেমিনারিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে ভর্তি হন এবং পরে ফিলাডেলফিয়ার ভিলানোভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর তিনি শিকাগোর ক্যাথলিক থিওলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিভিনিটিতে মাস্টার্স এবং রোম থেকে ক্যানোন লয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি পেরুতে আগস্টিনদের সঙ্গে মিশনারি হিসেবে যোগ দেন এবং এক দশক ধরে সেখানে কাজ করেন।
১৯৯৯ সালে শিকাগো ফিরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্ট অঞ্চলের আগস্টিনদের প্রাদেশিক প্রধান হন এবং পরে অর্ডারের বৈশ্বিক প্রধান (প্রায়র জেনারেল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০১৪ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে পেরুর উত্তরাঞ্চলের চিকলায়ো ডায়োসিসের অ্যাপোস্টলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ফের নিয়োগ দেন।
প্রায় এক দশক পর ২০২৩ সালে কার্ডিনাল মার্ক উয়েলেটের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর এবং তার বয়সজনিত কারণে পদত্যাগের প্রেক্ষিতে প্রেভোস্টকে ডিক্যাস্ট্রির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় ভ্যাটিকান তার বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করে দেয়। প্রেভোস্ট বর্তমানে পন্টিফিকাল কমিশন ফর ল্যাটিন আমেরিকার সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।
২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভোগার পর ৮৮ বছর বয়সে পোপ ফ্রান্সিস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসের প্রথম লাতিন আমেরিকান এবং যাজক সম্প্রদায়ের বাইরে থেকে আসা এই পোপ তার ন্যায়বিচার, দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি এবং পরিবেশ সচেতন বার্তার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন একাধারে প্রগতিশীল চিন্তক ও বিনয়ী মানুষ। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শরণার্থী সংকট এবং যৌন নিপীড়নের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে অকপট বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ভ্যাটিকানে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক শোক এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান।
৬ এপ্রিল, পোপ ফ্রান্সিসকে সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার নিচে, অন্যান্য পোপদের পাশেই সমাহিত করা হয়। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা এবং লাখো ক্যাথলিক বিশ্বাসী। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আয়োজিত এ সমাহিতকরণ অনুষ্ঠান ক্যাথলিক গির্জার ইতিহাসে এক গভীর আবেগের মুহূর্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সূত্র: এএফপি
এসজেড