রাজধানীর সড়কে দিনদিন বাড়ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও প্যাডেলচালিত রিকশার দাপট। এ অবস্থায় রিকশা নিয়ন্ত্রণে নগরের কয়েকটি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু বাস্তবে এ উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি, বরং নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
রাজধানীর একাধিক জায়গায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রিকশাগুলো অনায়াসেই ট্র্যাপার পার হচ্ছে। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেটকারের টায়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে ট্র্যাপারের মতো লোক দেখানো পদক্ষেপ কার্যকর নয়। এজন্য প্রয়োজন নিবন্ধন ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, গত মার্চ মাসে পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর তিনটি স্থানে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসানো হয়। তখন কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে ব্যাটারি গলি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ নম্বর গেটের সামনে এবং পুরাতন রমনা থানার সামনের সড়কে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসানো হয়। পরে আরও কয়েকটি এলাকায় এটি বসানো হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। প্যাডেল রিকশাসহ এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ঢাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। আগে বেশির ভাগ রিকশাই অলিগলিতে চলত। তবে গত বছরের শেষের দিক থেকে এসব রিকশা মূল সড়কে উঠে এসেছে। ফলে রাজধানীর সড়কে ‘রিকশার বিস্ফোরণ’ হয়েছে— মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। এসব রিকশার কারণে একদিকে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীর সড়কগুলোতে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত যানবাহন ও গণপরিবহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
আরও জানা যায়, অটোরিকশা শুধু রাজধানীর সড়কগুলোর জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়ায়নি, জাতীয় স্বার্থকেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ, লাখ লাখ রিকশার ব্যাটারি চার্জ করতে গ্রাহক পর্যায়ের বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। এতে চাহিদার সময় বিদ্যুতের ওপর চাপ বাড়ছে, যা বিভিন্ন সময় লোডশেডিংয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে রিকশা-অটোরিকশা। মূল সড়কে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করছে। এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে ট্র্যাফিক পুলিশকেও। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সড়কের শৃঙ্খলা, বাড়ছে যানজট।
এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে রিকশা নিয়ন্ত্রণে ‘ট্র্যাপার’ বসানোর পরিকল্পনা করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অবৈধ। সুতরাং এগুলো রাজধানীতে কেন চলবে, এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তাহলে এ ট্র্যাপার বসিয়ে অবৈধ রিকশাগুলোকে কি বৈধতা দিচ্ছে প্রশাসন? লাখ লাখ অটোরিকশা ঢাকা শহরে, এগুলোর চলাচল কি এ ট্র্যাপার দিয়ে আটকানো যাবে? এসব পদক্ষেপ মূলত লোক দেখানো, এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, একদিকে এসব ট্র্যাপারের কোনো কার্যকারিতা নেই, অন্যদিকে প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহন ট্র্যাপারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যক্তিগত যানবাহন যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার দায় কে নেবে? ট্র্যাপারের মাধ্যমে রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়া অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। এটির পেছনে প্রশাসনের অযথা অর্থ নষ্ট হচ্ছে এবং কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অনেকাংশে এ ট্র্যাপার বসানোর ফলে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। একটি রিকশা বা অন্য কোনো যানবাহন ট্র্যাপারে আটকে গেলে সেখানে ২০ থেকে ২৫ মিনিটের যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এ যানজট ওই নির্দিষ্ট রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ছে। তাহলে এটা দিয়ে লাভ হলো কি?
‘সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রিকশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এরপর আইন ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অটোরিকশার উৎপাত কমানো সম্ভব।
এ বিষয়ে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এহসান বলেন, ‘ট্র্যাপারের কারণে অন্য যানবাহনের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এটি দিয়ে অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অটোরিকশাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এভাবে আস্তে আস্তে একটি সিস্টেম তৈরি করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু ট্র্যাপার দিয়ে হবে না।’
গত শুক্রবার (২ মে) রাজধানীর কাকরাইল ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে ব্যাটারি গলিতে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ রিকশা স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রী নিয়ে ট্র্যাপার পার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে মাঝেমধ্যে দু-একটি রিকশা ট্র্যাপারে আটকে যাচ্ছে এবং টায়ার পাংচার হয়ে যাচ্ছে। এতে ওই রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে স্বল্প ও দীর্ঘ সময়ের যানজট, বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি।
আরও দেখা যায়, রিকশাগুলো কোনো না কোনোভাবে পার হলেও মাঝেমধ্যে ট্র্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাইভেটকারের টায়ার। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান প্রাইভেটকারের চালকেরা। এমনই এক চালক আলামিন মিয়া। বলেন, ‘আমার গাড়ির চাকা এখন নষ্ট হলো, এর দায় কে নেবে? আমি মালিককে কি জবাব দেব? রাস্তায় এসব লোহার রড বসিয়ে কি কোনো লাভ হবে? ঢাকা শহরের রাস্তা দখল করে নিয়েছে অটোরিকশা। তাদের জন্য রাস্তায় গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়েছে। এসব লোক দেখানো ব্যবস্থা (ট্র্যাপার) তো কোনো কাজে আসছে না, উল্টো আমরা গাড়িচালকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
সরেজমিনে রাজধানীর রমনা এলাকায় বসানো কয়েকটি ট্র্যাপারও রিকশাচালকদের পার হয়ে যেতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে চালকদের কিছুটা কষ্ট হলেও রিকশা আটকানো যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে রমনা এলাকার রিকশাচালক মহিবুল মিয়া বলেন, ‘আমরা পেটের দায়ে রিকশা চালাই। এখন রাস্তার অনেক জায়গায় লোহার খাঁচা বসাইছে। মাঝেমধ্যে টায়ার পাংচার হইয়া যায় ঠিকই কিন্তু কী করব, যাত্রী নিয়ে তো যাইতেই হয়। তবে এই লোহার খাঁচাতে আমাদের তেমন সমস্যা হয় না।’
এদিকে, বিভিন্ন জায়গায় বসানো ‘অকার্যকর’ ট্র্যাপার নিয়ে ট্র্যাফিক পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, ট্র্যাপার কোনো কাজেই আসছে না। ঢাকা শহরে লাখ লাখ রিকশা, মূল সড়কের ৫০ শতাংশ জায়গা রিকশাচালকরা দখল করে রাখে। এসব ট্র্যাপার দিয়ে এ সমস্যা কোনোভাবেই সমাধান করা যাবে না। এগুলোর কারণে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে আরও সমস্যা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির ট্র্যাফিক বিভাগের মাঠপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্র্যাপার একটি অহেতুক জিনিস, এটার কোনো কার্যকারিতা নেই। এটির কারণে রাস্তায় আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে এগুলো বসানো হচ্ছে, সে উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। অটোরিকশা অবৈধ। এগুলো যাতে রাস্তায় চলতে না পারে সেজন্য শুধু ট্র্যাফিক বিভাগকে নয়, সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে ঢাকার রাস্তায় ট্র্যাফিক ব্যবস্থার অবনতি দিনদিন বাড়বে।’
তবে ট্র্যাপার বসানো এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে মাঠপর্যায়ের ট্র্যাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তারা বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ট্র্যাপার নিয়ে ক্ষুব্ধ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা আশাবাদী নন। তারা এর কোনো কার্যকারিতা দেখতে পারছেন না।
এ বিষয়ে কথা বলতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্র্যাফিক) মো. সরওয়ারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তাকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হয়। দুদিনেও তিনি কোনও জবাব দেননি।
thebgbd.com/NIT