ঢাকা | বঙ্গাব্দ

মাত্র দুই বছরেই বেহাল দশা ১১৭ কোটির বাস টার্মিনাল!

২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিউনিসিপ্যাল গভর্নেন্স সার্ভিস প্রজেক্টের আওতায় ৮ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয় টার্মিনালটি।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৬ মে, ২০২৫
মাত্র দুই বছরেই বেহাল দশা ১১৭ কোটির বাস টার্মিনাল! কদমতলী বাস টার্মিনাল।

মাত্র দুই বছর আগে উদ্বোধন হওয়া সিলেটের কদমতলী বাস টার্মিনাল এখন অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ‘ধ্বংসের দিকে’ এগোচ্ছে। অত্যাধুনিক এ টার্মিনালটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। নির্মাণের মান, ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও ধারণক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।


২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিউনিসিপ্যাল গভর্নেন্স সার্ভিস প্রজেক্টের আওতায় ৮ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয় টার্মিনালটি। 'আসাম টাইপ' নকশায় নির্মিত টার্মিনালটি ছিল দেশের অন্যতম আধুনিক বাস টার্মিনাল। এখানে রয়েছে প্রায় ৯৭০ আসনের যাত্রী বিশ্রামাগার, ৩০ আসনের ভিআইপি কক্ষ, ৩০টি টিকিট কাউন্টার ও আলাদা নামাজঘর। তবে উদ্বোধনের পর মাত্র দুই বছর পার না হতেই এর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে।



রোববার (২৫ মে) সরেজমিনে দেখা যায়, টার্মিনালের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। বিশেষ করে বিশ্রামাগারের একটি দেয়ালে বিশাল ফাটল দেখা দিয়েছে, যেখানে কেবল দুটি লোহার খণ্ড বসিয়ে 'সাময়িক' ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার তালাবদ্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ারে লেগেছে জং, লাইট ঝুলে পড়ছে, ছাদে পানি চুঁইয়ে পড়ার চিহ্নও মিলেছে।


যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ৯৭০ আসনের বিশ্রামাগার এখন অপরিচ্ছন্ন ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও টার্মিনালের দামি কাচের গ্লাসে সাঁটানো হয়েছে নির্বাচনী পোস্টার, যা কর্তৃপক্ষের অবহেলারই প্রতিফলন।


আজিজুল হক নামে নামে এক যাত্রী বলেন, এখানে এসে অপেক্ষা করতে ভয় লাগে। দেয়ালে ফাটল, উপরে ঝুলে থাকা লাইট- এভাবে কেউ কীভাবে নিরাপদে যাত্রা করবে?


রাব্বি হাসান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘টার্মিনালটি যখন উদ্বোধন হয়েছিল, খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম অবশেষে একটি পরিপাটি, নিরাপদ জায়গা পাচ্ছি যাতায়াতের জন্য। কিন্তু এখনকার চিত্র দেখলে হতাশ হতে হয়। দেয়ালে ফাটল, চেয়ার ভাঙা, লাইট নেই। এগুলো আধুনিকতার কোনো নমুনা হতে পারে না।’


রাবেয়া আক্তার নামে এক নারী বলেন, ‘আমাদের জন্য টার্মিনাল ব্যবহার করা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। টয়লেটগুলো নোংরা, নিরাপত্তা নেই, আর নারীদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রাম বা বসার জায়গাও খুব অগোছালো।’


প্রতিদিন সিলেট শহর থেকে প্রায় ৮০০ বাস চলাচল করলেও টার্মিনালের ধারণক্ষমতা মাত্র ২৮০ বাস। ফলে অধিকাংশ বাস রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়, যার ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। সড়ক দখল করে রাখা বাসের কারণে সাধারণ মানুষ, পথচারী ও যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।


সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাজী ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘টার্মিনালের যে অবস্থা এখন, তা পুরোদমে সংস্কার দরকার। একইসঙ্গে অতিরিক্ত জায়গা অধিগ্রহণ করে টার্মিনাল সম্প্রসারণ করতে হবে, তা না হলে যানজট সমস্যার সমাধান হবে না।’


টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বসানো হয়েছে ১৩০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু তার মধ্যে ১১টি ইতোমধ্যে বিকল হয়ে গেছে। ক্যামেরা অপারেটরের ভাষ্য, ঝড়-তুফানে ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।


এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত। টার্মিনালের জায়গা সংকট রয়েছে, তাই নতুন করে জায়গা অধিগ্রহণ করে টার্মিনাল সম্প্রসারণের প্রস্তাবনা রয়েছে। এছাড়া সংস্কার কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।’


শ্রমিক নেতা আলী আকবর রাজন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন প্রায় ৮০০ বাস চালাই, কিন্তু মাত্র ২৮০ টির জায়গা রয়েছে টার্মিনালে। ফলে আমরা বাধ্য হয়ে রাস্তার ওপর বাস রাখছি। এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। অবিলম্বে টার্মিনালের সম্প্রসারণ প্রয়োজন।’


একইসঙ্গে মালিক পক্ষও এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সিলেট মহানগর পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘অসংগঠিত ব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি তৈরি করা যাচ্ছে না। এর ফলে যাত্রীদের অভিযোগ বেড়েছে এবং বাস কাউন্টারেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।’


সিলেটবাসীর প্রত্যাশা ছিল এই টার্মিনাল আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মডেল হবে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ঠিক উল্টো। নগরবাসীর অনেকে বলছেন, এত টাকা খরচ করে যদি সঠিক তদারকি না থাকে, তবে এই উন্নয়ন জনগণের কোনো কাজে আসে না।


মাহবুব হাসান নামে এক সামাজিক সংগঠক বলেন, ‘টার্মিনালটি নির্মাণের সময় যথেষ্ট গণশুনানি বা অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে গেছে। এখন অন্তত সংশোধনের সুযোগ থাকা উচিত।’


তিনি আরও বলেন, ‘এ টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা একটি ম্যানেজমেন্ট ইউনিট গঠন করা প্রয়োজন। একইসাথে সিসিকের তদারকি কার্যক্রম বাড়াতে হবে এবং পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও নাগরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করা উচিত।’


thebgbd.com/NIT